
বিপণনের অভাবে ক্ষতির সম্মুখীন কৃষিখাত


বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ কৃষিনির্ভর। দেশের জিডিপির ১৪.১০ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনসংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। সার-কীটনাশকে ভুর্তকি প্রদান, নিয়মিত বীজ সরবরাহ, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশে প্রথম, সবজিতে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে অষ্টম, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টন যেখানে দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ৮৫-৯০ লাখ টন, সবজি উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন, ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন, আম উৎপাদন হয় ১ লাখ ৭৯ হাজার টন। বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন স্বাদু পানির মাছ উৎপাদিত হয়েছে, চা উৎপাদন হয়েছে ৯৬.৫১ মিলিয়ন কেজি। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা ও যথাযথ তদারকির ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়লেও সে হারে বাড়েনি কৃষিজাত পণ্য রফতানি আয়। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ যতটা এগিয়ে কৃষি বিপণনে ততটা পিছিয়ে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হিমাগারের অভাবে মৌসুমে ক্ষেতেই নষ্ট হয় অধিকাংশ সবজি। এছাড়া পরিবহণ সমস্যার কারণে পণ্য সুষম যোগান সম্ভব হয় না। হিমাগারের অভাবে সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকরা। এ সুযোগ লুফে নেয় কিছু অসাধু মধ্যস্বত্বভোগী। তারা কৃত্রিম বাজার সংকট তৈরি করে ক্রেতাদের নিকট চড়া দামে কৃষিপণ্য বিক্রি করে। ফলে উভয়পক্ষই ক্ষতি সম্মুখীন হয়। এছাড়াও জাহাজ-বিমানের পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, কন্টেইনার সংকটের কারণেও বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না রফতানি। রফতানির সুযোগ না থাকায় এবং হিমাগারের অভাবে প্রতিবছর মাঠেই নষ্ট হয় কয়েক লক্ষ টন আলু। দেশের আলুর উৎপাদন কোটি টনের উপরে হলেও রফতানি হয় ৪৫ হাজার টন মতো। বিশ্ববাজারে আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রায় ৪০টি দেশের প্রধান খাদ্য তালিকায় আলু থাকলেও চেষ্টার অভাবে বড় একটি বাজার আমরা দখল করতে পারছি না। এছাড়া আলু প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিস্কুট, চিপসসহ নানান মুখরোচক খাবার তৈরি করা গেলেও দেশে গড়ে ওঠেনি যথেষ্ট প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলে বাজার খুব সীমিত। দেশের কাচা সবজি রফতানির ৮০ শতাংশ হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও কুয়েত এই ছয়টি দেশে। বাকি ২০ শতাংশ রফতানি হয় ইতালি, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, সুইডেন, কানাডা, জার্মানির মতো অন্যান্য ৩৫টির বেশি দেশে। মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষে থেকেও রফতানিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। রফতানির সিংহভাগ আয় আসে চিংড়ি থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছের রয়েছ ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু সে খাতটিও অন্যান্য দেশগুলোর দখলে। বাংলাদেশে এক সময় দ্বিতীয় প্রধান রফতানি পণ্য ছিল চা। সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র বদলে গেছে। গত দশ বছরে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও কমেছে রফতানি। এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চা আমদানি করে তা প্যাকেটজাত করে চড়া দামে পুনঃরফতানি করে যার ফলে মুনাফার বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। পাট এক সময় দেশের প্রধান রফতানি পণ্য হলেও পাটজাতদ্রব্য আমরা বিশ্বের কাছে পরিচিত করাতে ব্যর্থ হওয়ার এ শিল্প এখন আর নেই বললেই চলে। দেশে আমের রফতানি কিছুটা বাড়লেও ব্র?্যান্ডিং ও প্যাকেজিংয়ের অভাবে তাও তেমন আশানুরূপ নয়। দেশ কৃষিক্ষেত্রে যেভাবে এগুচ্ছে সেভাবে যদি কৃষিপণ্যের বিপণন না হয় তবে কৃষক পণ্যের দাম পাবে না যা কৃষিখাতে উন্নতির প্রধান অন্তরায়। দেশের শ্রমশক্তি কৃষি খাতের একটি প্লাস পয়েন্ট সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় পারে দেশকে সমৃদ্ধ করতে। বিশ্ববাজারে দেশের কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ হতে পারে দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাই সার-কীটনাশক সরবরাহের পাশাপাশি কৃষিপণ্য বিপণনে বিশেষ মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
মো. তাজুল ইসলাম
শিক্ষার্থী : মার্কেটিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ